বাঙালি মুসলমানের পরিচয় সংকট
মুসলমানি নাম এবং হিন্দুয়ানি নামের মদ্ধে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায় আমাদের ইন্দো-বাংলা ভূখণ্ডে। কিছু নাম ধর্ম সংশ্লিষ্ট। যেমন আব্দুল্লাহ মুসলমানের নাম, দেব হিন্দুর নাম। খাদিজা মুসলমানের নাম, লক্ষ্মী হিন্দুর নাম।
কিন্তু কিছু নামের সাথে ধর্মীয় যোগ না থাকার পরেও সেগুলো হয় মুসলমান নয় হিন্দু নাম হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। সংস্কৃত অথবা বাংলা নামগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হিন্দুরা ব্যবহার করে। যেমন অভিষেক, নীলিমা ইত্যাদি। অপরদিকে, আরবি বা ফারসি নাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুসলমানরা ব্যাবহার করে। যেমন জামাল, মিনা ইত্যাদি।
অথচ ধর্মীয়ভাবে মুসলমানদের সংস্কৃত বা বাংলা নাম ব্যবহার করতে কোন সমস্যা থাকার কথা না। পারশ্য বা ইরানের মানুষ একসময় অগ্নিউপাসক ছিল। কিন্তু তাদের ভাল নামগুলো গ্রহণ করতে তাবেঈনদের কোন আপত্তি ছিল না। আবার, আরবের মূর্তিউপাসকদের মদ্ধেও যাদের নামে শিরকি অথবা মন্দ অর্থ ছিল না, তাদের নাম পরিবর্তন করতে আমাদের নবীজি নির্দেশ দেননি। একারণে, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলমানরা সাধারনত তাদের নিজ নিজ ভাষায় নাম রাখে। এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম আমাদের উপমহাদেশের মুসলমানরা।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের ধার্মিক মুসলমান শ্রেণীর ভালবাসার প্রবল অভাব লক্ষ করা যায়। অনেকসময় এই ভালবাসার অভাব রুপ নেয় বিদ্বেষে। শুধু ভাষা বা সংস্কৃতি নয়, পোশাকে-আশাকেও এই মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। বাঙালি হয়েও অনেকে বেশ ধারণ করে আরবের। আরবের মরুভূমির জন্য উপযুক্ত পোশাককে মনে করা হয় ইসলামী ধর্মীয় পোশাক। অথচ আল্লাহ যুগে যুগে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন, সবাই তাদের স্ব-গোত্রীয় ভাষা, পোশাক, আচার, আচরণ ধারণ করেছেন। যা কিছু আল্লাহর হুকুমের পরিপন্থি, তা তারা নিষেধ করেছেন; কিন্তু এর বাইরে নিজ সংস্কৃতিকে তারা ত্যাগ করেননি। আমাদের উম্মাহর ফেরাউন বলে আবু জেহেলকে অবিহিত করেছিলেন আমাদের নবীজি। অথচ, আবু জেহেল যেই পোশাক পরেছেন, আমাদের নবিজীও একই পোশাক পরেছেন। আবু জেহেল যা খেয়েছেন, সেই খাবারই খেয়েছেন নবীজি। আবু জেহেলের আসল নাম ছিল উমর। সেই উমর নাম রাখতেও নবীজি কাউকে নিষেধ করে যাননি। আবু বকরের পর তাঁর সবচেয়ে কাছের সাহাবির নামই ছিল উমর।
বাঙালি হয়ে বাঙ্গালিয়ানাকে অপছন্দ করার প্রবণতা প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের মুসলমানদের মদ্ধে ছিল। প্রাচীন বা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের অবদান অতি সামান্য। অল্প যা কিছু পাওয়া যায়, সেগুলিরও বেশিরভাগ অনুবাদ সাহিত্য, মৌলিক নয়। মধ্যযুগীয় বিখ্যাত মুসলমান কবি আব্দুল হাকিম আক্ষেপ করে লিখেছিলেন “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী; সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।“
এ অঞ্চলের মুসলমানদের এরূপ সংস্কৃতি বিদ্বেষের শিকার শুধু বাংলাই না,বরং ইংরেজিও। ব্রিটিশ আমলে হিন্দুরা যখন ইংরেজি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে স্কুল-কলেজ স্থাপন করছিল, মুসলমানরা তখন ইংরেজি শিক্ষাকে গণ্য করছিল অপছন্দনিয়।
আমাদের পূর্বপুরুষদের এই সমস্ত ভুলের খেসারত আমাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে এখনও। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলমান না জানে আরবি, না জানে ইংরেজি। এমনকি বাংলার জ্ঞানটাও বেশিরভাগের ক্ষেত্রে শুধু কথ্য ভাষাতেই সীমাবদ্ধ। প্রবল আরবপ্রেমের পরেও তাই আমরা আরবি ভাষাটাই জানি না। কুরআন শরীফ অর্থ বুঝে পরতে পারিনা। অথচ প্রতিটি মুসলমানের ছোটবেলা থেকেই আরবি ভাষা শিক্ষা জরুরি হওয়ার উচিত। আরবি না জানার কারণে আমাদের ইসলামী জ্ঞান পুরোপুরি নির্ভরশীল হুজুরদের উপর। অপরদিকে ইংরেজি না জানার কারণে আমরা বৈশ্বিক বাজারে ভারতীয়দের সাথে টক্কর দিতে হিমশিম খাচ্ছি।
তাই বাংলা/ইংরেজি শিক্ষা থেকে বিরত থাকার ফলে আমাদের কোন ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধন হয়েছে – এমন প্রমান পাওয়া যায়না। উল্টো বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসার অভাবে আমরা পরেছি পরচয় সংকটে। আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে এখনও আমরা ঐকমতে পোঁছাতে পারিনি। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের সময় বাঙালি সংস্কৃতি বিষয়ক বিতর্ক তাই বিরক্তিকর হলেও জরুরি। আমাদের সমষ্টিগত চেতনায় এই বোধ আসা প্রয়োজন যে সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি, সব সংস্কৃতিই আল্লাহর নেয়ামত। বাংলা ও বাঙ্গালিয়ানার প্রতি ভালোবাসা আমাদের মুসলমান পরিচয়ের জন্য হুমকি না। বরং সময়ের সাথে বাংলা হয়ে উঠতে পারে ইসলামী সংস্কৃতির অংশ, যেমনটা ঘটেছে ফারসি বা উর্দুর ক্ষেত্রে।
শুভ নববর্ষ ১৪৩২।